Monday, June 4, 2012

গল্পটা

      বিশাল হল ঘরটা প্রায় ফাঁকা। সারি দিয়ে রাখা অনেকগুলো বিছানা, তাতে লোহার রেলিঙ দেওয়া, আর পাশে স্যালাইনের বোতল টাঙ্গাবার স্ট্যান্ড- কিন্তু ঘরে রোগী প্রায় নেই বললেই চলে। হাসপাতালের ঘর আর রাত্তির বেলা বলেই বোধহয়  আলো নামমাত্র, শুধু গোটা দুয়েক CFL ল্যাম্প একটা সবজে সাদা আলো ছড়িয়ে দিয়েছে ঘরটাতে। সেই আলোরই  কিছুটা এসে পড়েছে বৃদ্ধ মানুষটার মুখে। সে মুখে মৃত্যু যে ছায়া ফেলেছে, আধো অন্ধকারেও সেটা বেশ বোঝা যায়। তাঁর ঠোঁট দুটি কিন্তু থেমে নেই- সেখান থেকেই ঘরের একমাত্র আওয়াজটা বেরিয়ে আসছে।


     " বুঝলে তো, গল্পটা আমি পড়েছিলাম অনেক ছোটবেলা-এ। এই দশ-বার বছর বয়েস হবে, তখন কোন এক পুজা বার্ষিকীতে পরেছিলাম, বলতে পার তার পর থেকেই লেখক হওয়ার ভূত চেপেছিল মাথা-এ। স্কুল থেকে কলেজ, সেই ভূত আর নামেনি মাথা থেকে।
       বোধহয় ভাবছ আমি বেশ একজন নামজাদা লেখক, একটা আত্মজীবনী গোছের কিছু বলতে বসেছি, তাই না? উঁহু, সে গুড়ে বালি, আমি একজন প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক, সারা জীবন ওই করেই কাটালাম। লেখার ভূত মাথায় চাপলেও, হয়ে ওঠেনি আর কি। তাছাড়া লেখক হতে গেলে কীসব ট্যালেন্ট, আর ইয়ে, অধ্যবসায় লাগে বলে শুনেছি-সে সব কোনদিন-ই খুব একটা..."
        কথা বলতে গিয়ে হাপিয়ে উঠছিলেন বৃদ্ধ, তাই কয়েক সেকনডের জন্য চুপ করলেন তিনি। ডিউটি নার্স অনিতা এতক্ষণ পাথরের মতন বসে ছিলেন রোগির শিয়রে, এইবার তাঁর ধ্যান ভঙ্গ হল- চকিতে একবার তাকিয়ে নিলেন বৃদ্ধের মুখের দিকে। নাহ, চোখদুটি খোলা; মানুষটা আছে  এখনো।


      "গল্পটা হল এক সাংবাদিক-কে নিয়ে। মফঃস্বল-এর নানা শহরে ছুটোছুটি করে খবরের মালমসলা সংগ্রহ করাই তার কাজ। ভাবছ বুঝি এইবার একটা ডাকাত কিংবা ভুতুড়ে কুঠি এনে ফেলব, তাই না? উঁহু, ঘটনা যেটা ঘটেছিল তা ভুতুড়ে কিনা জানিনে, কিন্তু মাঝ রাত্তিরের হাড় কাপান ব্যাপার  সেটাকে বলা চলে না। ইন ফ্যাক্ট, ঘটনাটা ঘটেছিল ভর দুপুরে।


        সুশান্ত না সুকান্ত, কি যেন নাম সেই সাংবাদিকের- যাক, ধরো তার নাম সুকান্ত। এক গ্রীষ্মের দিনে সে একটা বাসে উঠেছে, পুরুলিয়া-র কাছে কোন একটা গ্রামে একটা ডাকাতির খোঁজে যাবে বলে। একে বৈশাখ মাসের গরম, তার ওপর বাসের মধ্যে সূর্য যেন আগুন ঢালছে। কিন্তু বাসে উঠেই সুকান্তর মনটা বেশ ভাল হয়ে গেল। বাসের একেবারে শেষ সিটে একটা পুরনো চামড়া মোড়া কালো রঙের ডাইরি পড়ে আছে, যেন তারই জন্যে কেউ ওটাকে রেখে গেছে ওখানে। এমনিতে, সুকান্ত এমন পড়ে থাকা জিনিস ছুঁয়েও দেখে না- কিন্তু আজ কি মনে হোল, সে ডাইরি -টা তুলে পাতা ওলটাতে শুরু করল। 


        পরিষ্কার মুক্তোর মতন হাতের লেখায় হিন্দিতে লেখা ডাইরি সেটা- আদতে ছোটদের গল্প সেগুলো। এই ক্লাস ৫-৬  এর বাচ্চারা যেমন পড়ে, ধরো সেরকম। পাতা উল্টাতে- উল্টাতে বেশ অবাক-ই হয়েছিল সুকান্ত- এতো যত্ন করে দামী একটা ডাইরি -তে লেখা, হলই নয় সেটা ছোটদের গল্প, কিন্তু সেটা কি করে এমন অনাদরে পড়ে থাকে বাসের মধ্যে?"


        বৃদ্ধের কথা শুনে মনে হয় যেন তিনি কোন এক অতি আপনজনকে শোনাচ্ছেন গল্পটা। অনিতা নিজের মনেই একটু হাসলেন- মুমূর্ষু মানুষকে সঙ্গ দানের অভিজ্ঞতা তাঁর আজকের না। কিন্তু এই মানুষটা বেশ অন্যরকম, ওঁর কথা গুলোতে কোথাও মৃত্যুপথযাত্রীর অসংলগ্নতা নেই। শুনতে মন্দ লাগছিল না- গল্প  বলার অভ্যেশ-টা যেন তাঁর সহজাত।


         "সুকান্ত বাঙ্গালীর ছেলে হলেও হিন্দি-টা সে ভালই জানে- আসলে সাংবাদিক হতে গেলে অনেক কিছু শিখতে হয়, বুঝলে না? তা সেই ডাইরি- টা পড়ে ফেলতে তার বেশিক্ষন লাগল না। কিন্তু তাকে থমকে যেতে হল একেবারে শেষের পাতা-এ গিয়ে। ডাইরিটার এটাই শেষ পাতা, কিন্তু এই পাতার  হতাক্ষর মোটেই মুক্তোর মত নয়- ছোটদের গলপ-ও নয় এটা। সংক্ষেপে বললে সেটার মানে দাঁড়ায় এইরকম- মানুষের জীবন আসলে একটা উপলক্ষ বৈ আর কিছু না। এত যে হাজারো চিন্তা ভর করে আসে আমাদের মনে, তাদের-কে রূপদান, জীবন দান-ই আমাদের ধর্ম। যদি সেগুলোকে পাত্তা না দাও, তবে মুহূর্তের মধ্যে হারিয়ে যাবে তারা- আর যদি জোর  করে চেপে ধরে তাদেরকে বুঝতে চাও, তাহলে সেগুলো কয়েক টুকরো বাস্তব হয়েই পড়ে থাকবে। তবে যদি চিন্তা আর কল্পনা মিশিয়ে গল্প লিখতে পার, তবেই তাদের আসল কদর হয়। এই গল্প রচনাই মানুষের জীবনের আসল কৃতিত্ব। গল্প লেখা হয়ে গেলে সাহিত্যিকের জীবনের আর কোন মানে থাকে না- তার নবজীবন সেই গল্পের মধ্যে।
          
          লেখাটা পড়ে সুকান্ত বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থাকলো। বাস তখন প্রায় তার গন্তব্যস্থলে এসে গেছে। নামবার জন্য তৈরি হয়েও সে আর নামল না। তার মনে ততক্ষণে একটা আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে- পুরুলিয়ার গ্রামে ডাকাতির তদন্ত আজ আর তাকে দিয়ে হবে না। তাকে এখুনি কলকাতা ফিরতে হবে।


          এর দিন দুয়েক পরের ঘটনা। সুকান্ত অফিসের অরিন দত্ত-কে লাঞ্চ-এর সময় বলছিল গল্পটা- অরিনদার চেনা আছে কয়েকটা পত্রিকার অফিস -এ। এর মধ্যেই ডাইরি-টা নিয়ে কয়েক পাতা লিখে ফেলেছে সে- গল্পটা যদি কোন ভাবে ছেপে বের হয়, তবে মন্দ হয় না। অরিন-দাও খুব খুশি হয়েছিলেন গল্প-টা শুনে। সব কিছুই ঠিক ঠাক ছিল, কিন্তু বাদ সাধল ভাগ্য- সেইদিন বিকেলে বাড়ি ফিরবার পথেই একটা বাসে চাপা পরল সুকান্ত।


          অফিসের সবাই ভালবাসত তাকে; হাসিখুশি স্বভাবের ছেলে সুকান্ত- সকলেই বাস্তবিক শোকাহত হয়েছিল তার মৃত্যুতে। অরিন দত্ত-র কিন্তু হঠাৎ মনে হল, যদি কোন ভাবে সুকান্তর গল্পটা ছাপা যায়- তাহলে মানুষের মধ্যে তার একটা অংশ নবজীবন লাভ করবে। কোথাও না কোথাও সৃষ্টির মধ্যে বেচে থাকবে স্রষ্টা। 


আর কদিন পরেই দুর্গাপূজা। পূজাবার্ষিকীতে ছোটদের গল্প অংশে একটা গল্প ছেপে বের করে ফেলা কোন ব্যাপার নয় তার কাছে। অরিন দত্ত কথাটা ভুল ভাবেনি- তার পরিচিতির জোর সে বিলক্ষন জানতো। তবে পঞ্চমীর দিনে হাওড়া থেকে ছাড়া বোম্বে মেলের দুটো কামরা যে বেলাইন হয়ে যাবে, তা বোধহয় সে জানত না। নইলে কি আর সে ওই কামরা-র টিকেট কাটে?"


অনেকক্ষণ একটানা কথা বলে চুপ করলেন বৃদ্ধ। নার্স হিসেবে অনিতার অভিজ্ঞতা প্রচুর, কিন্তু আজ এই প্রায়ন্ধকার হাসপাতালের ঘরে বসে কথাগুলো শুনতে গিয়ে তাঁর ও যেন শিরদারা বেয়ে একটা হিমেল অনুভুতি নেমে গেল। কোনরকমে মনের ভাব চেপে তিনি আলতো করে বললেন- "তা বেশ গল্প বলেন তো আপনি! একটু লিখতে পারেন তো?"


      খানিকক্ষণ বৃদ্ধ কোন কথা বললেন না, তারপর জরিয়ে আসা গলা-এ উত্তর এল,"তা কেমন করে হয় নার্স, আমার যে জীবনে কত কিছু করার আছে। সেসব না সেরে কি আর নবজীবন লাভ করা যায়?"


      তারপরে আরও অনেকক্ষণ কেটে গেচ্ছে। ডক্টর মিত্র রাউনডে এসে দেখলেন বৃদ্ধর চোখ দুটো বোজা, হৃদপিণ্ডের গতি স্তব্ধ হয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। বেডের পাশে টেবিলে রাখা একটা টেপ রেকর্ডার তুলে নিলেন ডক্টর মিত্র। এটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ছেলেদের দেওয়া, যারা ওনাকে নিয়ে এসেছিলো। রাস্তার মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পরেছিলেন উনি, আশেপাশের কেউ চেনেও না ওনাকে। তাই অন্তত একটা আত্মপরিচয় যদি রেকর্ড করা সম্ভব হয়, সেই জন্যই যন্ত্রটা।
        ডাক্তার মিত্র সব-ই শুনেছিলেন অনিতার কাছে, শুনে বেশ অবাকই হয়েছিলেন। আর তখনি অনিতাকে বলেছিলেন, টেপ রেকর্ডার-টা উনি নিজের কাছেই আপাতত রাখতে চান। মুমূর্ষু মানুষের মুখে এই জাতীয় কোন কথা শোনার অভিজ্ঞতা তাঁর-ও এই প্রথম। এছাড়া আরও একটা কারণ আছে, সেটা উনি অনিতা-কে বলেননি।


 আসলে মেডিকেল কলেজে পরবার সময় থেকেই তিনি লিখতে ভালবাসেন, কিন্তু প্রায়শই কাজের চাপে সেটা আর হয়ে ওঠে না। আজ গল্পটা শোনার পর থেকেই ডাক্তারবাবুর মনে হচ্ছে, দেখাই যাক না একবার চেষ্টা করে। এমন একটা প্লট কি আর বারবার পাওয়া যায়?